কুড়িগ্রাম
কুড়িগ্রামে রয়েছে সাড়ে চারশ চরাঞ্চল ও ১৬টি নদ-নদী। এসব নদ-নদীর পানি বাড়লেও নদী ভাঙে, কমলেও ভাঙে। ফলে সারা বছরই এ অঞ্চলের মানুষের দুঃখের শেষ থাকে না। টেকসই বাঁধ আর নদী শাষণ ব্যবস্থা না থাকায় জেলার মানচিত্র দিন দিন ছোট হয়ে আসছে।নদীভাঙনের কবলে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছেন মানুষজন। এতে বেকারত্ব বাড়ছে। স্থানীয়দের দাবি, নদীভাঙনের হাত থেকে কুড়িগ্রাম জেলাকে মুক্ত করা গেলে বেকারত্বের পাশাপাশি দরিদ্রতাও কমে যাবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারাবছর বন্যার পানি বাড়া-কমার সঙ্গে তিস্তা, ধরলা, গঙ্গাধর, দুধকমুার নদী এবং ব্রহ্মপুত্র নদের অব্যাহত ভাঙনে বিলীন হচ্ছে একের পর এক গ্রাম। ঘরবাড়ি আর সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে শত শত পরিবার। ভাঙনে শত শত বিঘা আবাদি জমি, কাঁচা-পাকা সড়ক, মসজিদ ও গাছপালা এবং সরকারি-বেসরকারি অনেক স্থাপনা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তরা থাকার জায়গা না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন। নামকাওয়াস্তে সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ থেকে বিমুখ হয়ে নদীশাষণ ব্যবস্থায় স্থায়ী সমাধান চান এ জেলার মানুষজন। ১৬টি নদ-নদীর ৩১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদীপথে রয়েছে জেলার ৯টি উপজেলার তিনটি পৌরসভা ও ৭৩টি ইউনিয়ন। এরমধ্যে ৫৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা ভাঙনের শিকার। আর শতভাগ ভাঙনকবলিত দুটি উপজেলা চিলমারী এবং রাজিবপুর। জেলার মূল ভূখণ্ড থেকে পুরোপুরি বিছিন্ন আটটি ইউনিয়ন। প্রায় সাড়ে চারশ চরাঞ্চলে ৫-৭ লাখ মানুষের বসবাস। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ারচর গ্রামের নুরবানু বেওয়া বলেন, ‘বেশ কিছুদিন হইল (হলো) দুধকুমার নদীতে ঘরবাড়ি ভাঙ্গি গেইছে (গেছে)। কিছু জিনিস সরবার পাইলেও অনেক জিনিস ভাসি গেইছে। সেই কি নদীর ভাঙন। চোখের পলকে সব ভেসে গেইল (গেলো)।’ ফকিরপাড়া গ্রামের আব্দুর রহমান বলেন, ‘মাস দেড়কের মধ্যে ফকিরপাড়া আর মুন্সিপাড়া বিলীন হয়া গেইছে। প্রায় ৩০০-৪০০ পরিবার নিঃস্ব। থাকারও জায়গা নাই। যে যেখানে পাইছে আশ্রয় নিছে। এলা (এখন) হামার (আমার) কাজ নাই, হাতত (হাত) টাকা নাই। হু হু করি জিনিসপত্রের দাম বারবাইছে (বাড়ছে)। এলা এই মানুষগুলা বাড়ি করবে না প্যাট (পেট) বাঁচাইবে? এই চিন্তায় নদীভাঙন কবলিতরা অসহায় হয়া গেইছে।’ আব্দুল জলিল নামের আরেকজন বলেন, ‘ঘরবাড়ি হারিয়ে থাকার ভাড়া জমিও পাওয়া যাচ্ছে না। যেটুকু পাওয়া যায় সেটুকু বাড়ি করার উপযোগী না। তারপরও দাম বেশি। প্রতি বিঘা জমির ১০ বছর মেয়াদি ভাড়া ৩-৪ লাখ টাকা। শতক ১০-১৫ হাজার টাকা। নদ-নদীর ভাঙনে বেকারের সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কোনো শিল্প-কারখানা না থাকায় পরিবার নিয়ে কষ্টে দিন কাটাতে হয়।’ নাগেশ্বরী উপজেলার নুনখাওয়া ইউনিয়নের ব্যাপারীর চর গ্রামের বাসিন্দা ৭০ বছরের বৃদ্ধ সিফাত উল্লাহ। তিনি বলেন, বাপ-দাদারা এই চরে বসতি স্থাপন করেন। শত বছরের ওপরে এখানে তারা আছেন। হঠাৎ গতবছর চরটি দুধকুমার নদীর ভাঙনের মুখে পড়ে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধ করে। তবে ভাঙনে ১৫টি পরিবার সব কিছুই হারিয়েছে। কুড়িগ্রাম জেলার তিস্তা নদী ঘেঁষা গাইবান্দার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের সদস্য বাবলু মন্ডল বলেন, ‘তিস্তা নদীর ভাঙনে ৭-৮ মাস আগে আড়াইশ বাড়ি ভেঙে গেছে।’ চর নেওয়াজী বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বিদ্যালয়টি নদীভাঙনের মুখে। আমি ওপর মহলে কথা বলেও কোনো সাড়া পাচ্ছি না। এখন কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছি না আসলে কী করবো?’ মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য শাহ আলম বলেন, ‘ঢাকাইয়া পাড়ায় যে বাড়িগুলো ভেঙে গেছে তারা কয়েক দফায় ভাঙনের শিকার হয়ে এলাকায় বসতি গড়েন। কিন্তু সেটিও এখন ভেঙে গেলো। বর্তমানে এদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।’ কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, প্রায় ২০ কিলোমিটার ভাঙনের কবলে পড়েছিল। এরমধ্যে আমরা প্রায় আট কিলোমিটার ভাঙন রোধে কাজ করতে পেরেছি। তিনি আরও বলেন, ধরলা এবং দুধকুমার নদীতে ড্রেজিং করার জন্য একটি সমীক্ষা করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে দ্রুত কাজ শুরু করা হবে।
Leave a Reply